সকালে ঘুম থেকে উঠলেন, চারপাশে আলো ঝলমল করছে। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই বুকে এক ধরনের অস্বস্তি, যেনো কোনো অদৃশ্য হাত বুকের ভেতর চাপ দিয়ে ধরছে। হয়তো এটাই আপনার জীবনের শেষ সকাল হতে চলেছে। শুনতে ভয়ংকর শোনাচ্ছে, তাই না? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বিশ্বজুড়ে প্রতি ৩৬ সেকেন্ডে একজন মানুষ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতিবছর ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মারা যান— যা মোট মৃত্যুর ৩২%। এর মধ্যে বেশিরভাগই হার্ট অ্যাটাকের কারণে। ভাবুন তো, আমরা যখন এই লেখাটি পড়ছি, হয়তো বিশ্বের কোথাও কেউ একজন হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন।
একটা সময় হার্ট অ্যাটাককে শুধুমাত্র বয়স্কদের রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে, তরুণ বয়সেও হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের (AHA) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের হার গত দশ বছরে ৪০% বেড়ে গেছে। আমাদের লাইফস্টাইল, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ— সবকিছু মিলিয়ে যেনো এক নীরব ঘাতক আমাদের পেছনে লেগে আছে। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন যে আপনি বা আপনার কাছের কেউ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে চলেছেন? এই আর্টিকেলে আমরা জানবো সেই লক্ষণগুলো, যা আগে থেকেই ইঙ্গিত দিতে পারে কোন ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাক এর সম্ভাবনা কতটুকু।
যা হলে বুঝবেন হার্ট অ্যাটাক
তবে চলুন জেনে আসি হার্ট অ্যাটাকের কিছু সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে। এগুলো জানতে পারলে আমরা আরো দ্রুত সচেতন হতে পারবো এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সঠিক সময়ে নিতে পারলেই হয়তো বেঁচে যেতে পারে আমাদেরই আপন কারো মূল্যবান জীবন।
বুকে তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি
হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ হলো বুকে তীব্র ব্যথা বা চাপ অনুভব করা। এটি সাধারণত বুকের মাঝখানে শুরু হয় এবং কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হতে পারে। অনেকেই এটিকে এমনভাবে বর্ণনা করেন যেন কেউ বুকের ওপর ভারী কিছু চাপিয়ে দিয়েছে বা বুকটি চেপে ধরেছে। এই ব্যথা শুধু বুকেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি কাঁধ, বাহু, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যথাটি হালকা হতে পারে এবং তারা এটিকে গ্যাস বা হজমজনিত সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে ব্যথাটি সাধারণত হঠাৎ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তীব্রতর হতে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুকে এই ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করলে তা অবহেলা করা একদমই উচিত নয়। বিশেষ করে, যদি ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, ঘামাচি বা বমি বমি ভাব অনুভূত হয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হার্ট অ্যাটাকের প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণ করলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
শ্বাসকষ্ট বা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট
শ্বাসকষ্ট বা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া আরেকটি প্রধান লক্ষণ, যা হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস দিতে পারে। এটি এমন এক অবস্থা, যখন আপনি হঠাৎ করেই বুঝতে পারেন যে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। হার্ট সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে না পারলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছায় না। ফলস্বরূপ, আপনি শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হতে পারেন। এমনকি কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, এই শ্বাসকষ্ট বুকে ব্যথা ছাড়াই ঘটতে পারে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে।
যদি আপনি কোনো কাজ করছেন এবং হঠাৎ করেই শ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব করেন, তবে এটি অবহেলা করা একদমই ঠিক নয়। অনেকেই এটিকে সাধারণ ক্লান্তি বা অ্যাজমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে যদি বুকে চাপ বা অস্বস্তি যুক্ত হয়, তবে তা হার্ট অ্যাটাকের সঙ্কেত হতে পারে। জার্নাল অফ কার্ডিওলজির একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ৪০% হার্ট অ্যাটাক রোগী শ্বাসকষ্টের সমস্যার সম্মুখীন হন। তাই, দ্রুত চিকিৎসা না করালে এটি জীবননাশের কারণ হতে পারে।
ঘামাচি বা ঠান্ডা ঘাম
হার্ট অ্যাটাকের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো অতিরিক্ত ঘাম বা ঠান্ডা ঘাম হওয়া। বিশেষত, যদি কোনো শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই ঘামতে শুরু করেন, তবে তা একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। আপনার শরীর যখন পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহ পাচ্ছে না, তখন এটি উত্তেজিত হয়ে ঘাম তৈরি করে। এটি শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া, যা হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত বুকের ব্যথার সঙ্গে ঘাম দেখা দেয়, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবেও উপস্থিত হতে পারে।
অনেকেই ঠান্ডা ঘামকে হালকাভাবে নিয়ে থাকেন, বিশেষত গরম আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ট অ্যাটাকের আগে অনেকেই এই ধরনের অস্বাভাবিক ঘামের সম্মুখীন হন। মায়ো ক্লিনিকের মতে, ঘামাচির সঙ্গে যদি বুকে চাপ বা ব্যথা থাকে, তবে এটি হার্ট অ্যাটাকের একটি নিশ্চিত লক্ষণ হতে পারে। তাই, এই ধরনের ঘাম দেখা দিলে সতর্ক হওয়া জরুরি।
মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব
মাথা ঘোরা, হালকা মাথাব্যথা, কিংবা বমি বমি ভাবও হার্ট অ্যাটাকের একটি কমন লক্ষণ। সাধারণত এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অনেকে এটিকে গ্যাস্ট্রিক বা হজম সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে, এটি মূলত রক্তচাপ কমে যাওয়ার ফলে ঘটে। হার্ট যখন সঠিকভাবে পাম্প করতে পারে না, তখন মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পায় না, যার ফলে মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়।
মহিলাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো বিশেষভাবে বেশি দেখা যায়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহিলাদের ৩৫% হার্ট অ্যাটাক রোগী মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাব অনুভব করেন। তাই, যদি এই ধরনের অস্বাভাবিক লক্ষণগুলো হঠাৎ করে দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
অবসাদ বা অত্যধিক ক্লান্তি
অত্যধিক ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করাও হার্ট অ্যাটাকের একটি অন্যতম লক্ষণ হতে পারে, যা সাধারণত মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আপনি যদি অল্প পরিশ্রমেও প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করেন, তবে এটি হার্টের সমস্যা ইঙ্গিত করতে পারে। বিশেষত, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ক্লান্তি দেখা দিলে তা হার্টের সমস্যা হতে পারে। হার্ট যখন রক্ত পাম্প করতে সমস্যা অনুভব করে, তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, যার ফলে অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হয়।
অনেক সময় মহিলারা এটি নিয়ে চিন্তিত হন না, কারণ তারা এটি মানসিক চাপ বা অনিদ্রার কারণে হয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অবসাদ বা ক্লান্তি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে তা হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে। হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের মতে, মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৭০% হার্ট অ্যাটাক রোগী ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করেন। তাই, এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে গুরুত্বসহকারে তা নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
হাত, ঘাড়, চোয়াল, বা পিঠে ব্যথা
হঠাৎ করে আপনার হাত, ঘাড়, চোয়াল, বা পিঠে ব্যথা অনুভব করা হার্ট অ্যাটাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে, বাম হাতে বা কাঁধে ব্যথা সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক সংকেত হিসেবে ধরা হয়। হার্ট অ্যাটাকের সময় রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের চারপাশের পেশীগুলো সংকুচিত হতে থাকে, যার ফলে এই ব্যথা দেখা দেয়। এই ব্যথা সাধারণত বুক থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র পিঠ বা চোয়ালে দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক সময় মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের প্রধান লক্ষণ হিসেবে এই ধরনের ব্যথা দেখা দেয়, যা পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৪২% হার্ট অ্যাটাক রোগী বুকের ব্যথার পরিবর্তে চোয়াল বা পিঠে ব্যথা অনুভব করেন। তাই, হঠাৎ করে এই ধরনের ব্যথা অনুভব করলে সতর্ক হওয়া জরুরি।
হজমের সমস্যা বা বুকজ্বালা
অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের সময় হজমের সমস্যা, পেটের ব্যথা বা বুকজ্বালা অনুভব করেন, যা সাধারণত অ্যাসিডিটির লক্ষণ বলে ভুল করে বসেন। হার্ট অ্যাটাকের ফলে শরীরের রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে পেটের পেশীগুলোতে টান পড়ে, যার কারণে এই ধরনের অস্বস্তি দেখা দেয়। এই লক্ষণটি সাধারণত মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
যদিও হজমের সমস্যা অনেক কারণে হতে পারে, কিন্তু যদি এর সঙ্গে বুকের ব্যথা, ঘাম বা শ্বাসকষ্ট যুক্ত হয়, তবে তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে। ন্যাশনাল হার্ট, লাং, অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউটের (NHLBI) মতে, হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের মধ্যে প্রায় ৩০% মানুষ বুকজ্বালা বা হজমের সমস্যার সম্মুখীন হন। তাই, পেটের অস্বস্তি বা বুকজ্বালা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
আপনার হার্ট যদি হঠাৎ করে দ্রুত বা অনিয়মিতভাবে স্পন্দন করতে শুরু করে, তাহলে এটি হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে। সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক চাপ, বা উদ্বেগের কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু যখন এটি কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই হয়, তখন তা হার্টের সমস্যার সংকেত হতে পারে। হার্টের পেশীগুলো যখন পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, তখন এর স্বাভাবিক কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটে, যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মতে, প্রায় ২০% হার্ট অ্যাটাক রোগী দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন অনুভব করেন। বিশেষত, যদি হৃদস্পন্দনের সঙ্গে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বা মাথা ঘোরা যুক্ত হয়, তবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
পা, গোড়ালি বা পায়ের আঙ্গুল ফুলে যাওয়া
হার্ট যখন ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, বিশেষত পা, গোড়ালি বা পায়ের আঙ্গুলে। এটি হার্ট ফেইলিওরের একটি সাধারণ লক্ষণ। শরীরে অতিরিক্ত তরল জমা হওয়ার ফলে এই ফোলা দেখা দিতে পারে। এমনকি আপনার পা বা গোড়ালির আকার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে এবং স্পর্শ করলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ১০% হার্ট অ্যাটাক রোগীর পায়ে ফোলাভাব দেখা দেয়। তাই, যদি আপনি হঠাৎ করেই পা বা গোড়ালি ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যার সম্মুখীন হন, তবে তা হার্টের সমস্যা নির্দেশ করতে পারে এবং অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
চরম মানসিক চাপ বা আতঙ্ক
হার্ট অ্যাটাকের আগে অনেকে চরম মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বা আতঙ্ক অনুভব করেন। এটি এমন এক অনুভূতি, যেন আপনি কোনো অনিরাপদ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। হার্টের সমস্যার কারণে আপনার মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম পৌঁছালে এই ধরনের অস্বাভাবিক অনুভূতি দেখা দিতে পারে।
অনেকেই এটিকে প্যানিক অ্যাটাক বলে ভুল করেন, কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হার্ট অ্যাটাকের আগে ২০% রোগী চরম আতঙ্ক বা উদ্বেগের সম্মুখীন হন। তাই, যদি আপনি হঠাৎ করে চরম মানসিক চাপ বা আতঙ্কে ভুগতে থাকেন, তা অবহেলা না করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা কিভাবে বুঝবেন?
হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীর শরীরে একাধিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। প্রথমত, রোগীর বুকে তীব্র ব্যথা বা চাপ অনুভূত হতে পারে, যা বুকের মাঝখানে শুরু হয় এবং কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত বুকের মাঝখানে হয়, কিন্তু এটি কাঁধ, হাত (বিশেষত বাম হাত), ঘাড়, চোয়াল বা পিঠে ছড়িয়ে যেতে পারে। অনেক সময় রোগী এটি গ্যাস বা হজমের সমস্যা বলে ভুল করে ফেলেন। ব্যথার সঙ্গে যদি শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, ঠান্ডা ঘাম, বা বমি বমি ভাব অনুভূত হয়, তাহলে এটি হার্ট অ্যাটাকের পরিষ্কার লক্ষণ হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, রোগীকে শুইয়ে রাখুন, তার বুকের চাপ কমাতে সাহায্য করুন এবং যত দ্রুত সম্ভব জরুরি সেবা (যেমন: অ্যাম্বুলেন্স) ডাকুন।
হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেলিওরের মধ্যে পার্থক্য কী?
দ্বিতীয়ত, রোগী যদি হঠাৎ করে শ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব করেন এবং শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বা ক্ষীণ হয়ে যায়, তবে তা হার্ট অ্যাটাকের সংকেত হতে পারে। অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের ফলে রোগীর শরীরে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়, যার কারণে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও, রোগীর ত্বক ফ্যাকাশে বা নীলচে হয়ে যেতে পারে, বিশেষত ঠোঁট ও নখের চারপাশে। যদি কোনো রোগীর এমন অবস্থা দেখা যায়, তবে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শে রোগীকে অ্যাসপিরিন দেওয়া যেতে পারে, কারণ এটি রক্ত পাতলা করতে সহায়তা করে এবং হার্ট অ্যাটাকের গুরুতরতা কমাতে পারে। তবে, অ্যাসপিরিন খাওয়ানোর আগে নিশ্চিত হয়ে নিন রোগীর এর প্রতি কোনো এলার্জি নেই। এই ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া জীবন বাঁচাতে পারে।
কিছু শেষ কথা,
জীবন মূল্যবান এবং তা রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের নিজেদের। হার্ট অ্যাটাক যেমন হঠাৎ করেই আসে, তেমনি সামান্য সচেতনতা আর কিছু সাধারণ পরিবর্তনেই আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পারি। মনে রাখবেন, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো যদি আপনি দ্রুত চিনতে পারেন, তবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়ে আপনার বা আপনার প্রিয়জনের জীবন বাঁচানো সম্ভব। অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে এড়িয়ে যান, আর এটাই হয়ে ওঠে মারাত্মক ভুল। আপনার শরীর কখনোই আপনাকে মিথ্যা সংকেত দেয় না; আপনাকে শুধু সেই সংকেতগুলো বুঝতে শিখতে হবে।
তাহলে, আপনি কি এই সংকেতগুলো সম্পর্কে সচেতন আছেন? নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ কমানো এবং পর্যাপ্ত ঘুম- এই চারটি চাবিকাঠি পারে আপনাকে সুস্থ রাখতে। জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (JAMA) মতে, সঠিক লাইফস্টাইল মেনে চললে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৮০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
স্মরণ রাখুন, সময়ের একফোঁড়, অসময়ের দশফোঁড়। তাই আজ থেকেই সচেতন হোন, আপনার হৃদয়কে ভালোবাসুন। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। সুস্থ হৃদয় মানেই সুস্থ জীবন, আর সুস্থ জীবন মানেই আপনার প্রিয়জনদের জন্য আরও কিছু মধুর সময়। কারণ, জীবন একটাই— আর সেটি যেন কোনো অসময়ে থেমে না যায়।